নিকপিক

 


নিকপিক

অনেক অনেক দিন আগে এক দূর দেশে একটা রোদ ঝলমলে সকাল হল। নীল রঙ মাখানো আকাশ তাইতে সাদা মেঘের দল হুটোপাটি করে সূয্যিমামার সাথে লুকোচুরি খেলছে। গাছের বাদামী ডালে সবুজ পাতারা বাতাসের ঝাপটায় লুটোপুটি করছে। সে এক ভারি মজার দিন। এমন দিনে কি কারোর মাটির তলায় ঢুকে বসে থাকতে ভালো লাগে? তাই সেদিন মোটু কেঁচো আর ছোটু কেঁচো মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁড়তে ওপরে বেরিয়ে এল শেষমেষ। যেই না বেরনো চোখে আলোর ঝিলিক লেগে তো চারিদিক ভোঁ ভাঁ করতে লাগল। মোটু আর ছোটু তো কিছু ঠাহর করতে না পেরে এদিক ওদিক কানামাছির মত চলে বেড়ায়। এটায় সেটায় পাথরে নুড়িতে গাছের ডালে হোঁচট লেগে ধাঁই ধপাধপ আছাড় খায়। এমন সময় কে যেন বলে উঠল, 

-“কে হে তোমরা গোমুখ্যু! আঁধার থেকে আলোয় এলে চোখে হাত চাপা দিতে হয় জানো না? দুম করে বলা নেই কওয়া নেই মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েই ড্যাবড্যাব করে আকাশপানে চেয়ে রইলে যে বড়! এই যে আমি যখন খোলস থেকে বেরিয়ে টুকি করে চোখে সবসময় রোদচশমা পরে থাকি। বলি তোমাদের কি সেটুকুও মাথায় ঘিলু নেই?”

এত বকুনি শুনে তো মোটু আর ছোটুর চোখের ভোঁ ভাঁ কেটে গিয়ে কানে ঝিঁ ঝিঁ শুরু হয়ে গেল। কোনও মতে পিটপিট করে চোখ মেলে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কে কথা কইছে। একটা আপেলগাছের গোড়ায় অনেকটা মোটু ছোটুর মতই দেখতে একজন তবে তার পিঠের ওপর ইয়া বড় একটা বাড়ি। কী মজাদার জিনিস রে বাবা! নিজের বাড়ি নিজের পিঠে করেই বইছে। মোটু ছোটু হেঁকে বলে, 
-“তা তুমিই বা কে হে বাপু! আগে তো কখনও আমাদের মাটির তলার পাড়ায় তোমায় দেখিনি? তুমি কি ওই বাড়ি ঘাড়ে করেই ঘুরে বেড়াও সবজায়গায়? 
তোমার ঘাড়ে ব্যথা হয় না? 
পিঠ কনকন করে না? 
কোমর টনটন করে না?”

সেই বকবকুনি বাড়িপিঠোটা বলে উঠল, 
-“সাধে কি তোমাদের গোমুখ্য বললাম? জানো না আমি শামুকমশাই! আর এইটে আমার বাড়ি বলো ঘর বলো খোলস বলো ঢাল বলো সবই! আসুক তো দেখি কোনও ব্যাঙ মুরগী ইঁদুর আমায় খুঁটে খেতে। দাঁতই ভেঙে যাবে, ঠোঁটই বেঁকে যাবে, জিভই আটকে যাবে। আর তোমাদেরকে তো পেলেই টপাটপ করে গিলে নেবে সবাই। ওইজন্যই তোমরা মাটির নিচে লুকিয়ে থাকো। আর আমি কেমন বুক ফুলিয়ে মাটির ওপর ঘুরে বেড়াই দেখো।”

আপেল গাছটার তলায় তিনজনে ঝগড়াঝাটি বেশ জোরদার জমে উঠেছে। মোটু ছোটু বলে খোলস জিনিসটা বেজায় বাজে, কোনও কাজের নয়। খামোখা পিঠের ওজন বাড়ানো। তার ওপর পিঠ চুলকোলে কী উপায়? 
ওদিকে শামুকমশাই জবাব দেয় যে খোলস ছাড়া মানুষ নাকি মানুষই নয় ইয়ে মানে কেঁচো নাকি শামুকই নয়। এই বলে পিঠের খোলস থেকে দুটো টাটকা বটপাতা বার করে কচরমচর করে চিবোতে লাগল শামুকমশাই। 
-“দেখলে আমার খোলসে দরকারে আমি খাবারদাবারও জমিয়ে রাখতে পারি!”

এমন সময় গাছের ওপর থেকে রিনরিনে সুরেলা গলায় কে যেন বলে উঠল, 
-“এই তোমরা তখন থেকে খালি ঝগড়াই করে চলেছো আমার বুঝি খিদে পায় না? দাও দেখি আমাকেও একটা বটপাতা শামুকমশাই। আগে সবাই পেটপুরে খেয়ে নিই তারপর নাহয় জমিয়ে ঝগড়াঝাটি করা যাবে। দাও দেখি ওই মোটু ছোটুকেও দু’টো করে পাতা।”
মোটু ছোটু আর শামুকমশাই ওপরপানে চোখ তুলে দেখে একটা সাতরঙা কেঁচোর মত কে যেন আপেলগাছের ডাল থেকে কথা কইছে। তার মাথায় আবার একটা লাল ফিতে ফুল বাঁধা। তিনজনেই হকচকিয়ে গেছে দেখে সেই সাতরঙা লালফিতেমাথা খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠল,
-“ও হো! আমার নামটাই তো বলিনি তোমাদের। আমি হলুম সাতরঙা শুঁয়োবতী। শামুকমশাইয়ের মত আমার খোলস নেই আর মোটু ছোটু কেঁচোভাইদের মত মাটির ভেতরও লুকোতে পারিনে তবে আমার গায়ে রোঁয়া আছে, তা জানো? কেউ ধরতে এলেই দেব পিঁকপিঁকপিঁকপিঁক করে ফুটিয়ে। তারপর এইসান চুলকোবে না ঠ্যালা বুঝবে!”

শুঁয়োবতীর কথা শুনে মোটু ছোটু আর শামুকমশাইও হেসে উঠল। 

শুঁয়োবতী ফের বলে উঠল, 
-“তবেই বোঝো! যে যেরকম সে সেরকমই ভালো! শামুকমশাই খোলসে ভালো আছে, মোটু ছোটু মাটির ভেতর দিব্যি রয়েছে, আর আমি রোঁয়ার চাদরে বেশটি আছি। তাই না?
চলো চলো আর বেশি কথা না বাড়িয়ে এই বেলা বরং চারজনায় নিকপিক করি।” 

মোটু ছোটু শামুকমশাই অবাক হয়ে বলে,
-“নিকপিকটা আবার কী জিনিস গো শুঁয়োবতী? আগে তো কখনও নাম শুনিনি!”
শুঁয়োবতী কুটুর কুটুর করে আপেলগাছের ডাল থেকে বড়সড় লাল টুকটুকু আপেলের গোড়াটা কামড়াতে কামড়াতে বলে, 
-“সবাই যখন যে যার খুশিমত খাবার এনে একজায়গায় বসে ভাগাভাগি করে খায় তাকেই বলে নিকপিক।”
শামুকমশাই হো হো করে হেসে বলে, 
-“ওটা নিকপিক নয় গো পিকনিক, পি ক নি ক!”
মোটু ছোটু কেঁচোভাইয়েরা হইহই করে বলে,
-“না না! নিকপিক পিকনিক পিকপিক ওসব কিস্যু নয়, ওটাকে তো আমরা চড়ুইভাতি বলি।”

শুঁয়োবতী এদিকে আপেলের গোড়াটা গাছ থেকে আলগা করে কেটে ধুপুস করে নিচের ঘাসের ওপর ফেলেছে। 
-“আরে বাবা যে নামেই ডাকো না কেন একসাথে খাওয়া আর মজা করাটাই আসল তো নাকি? শামুকমশাই তুমি আরো চারটিখানি কচি পাতা আনো দেখি!”
মোটু-ছোটুও বলে উঠল, 
-“আমরাই বা বাদ যাব কেন? শুধু কি বসে বসে খাবো নাকি? দাঁড়াও এখনই মাটির তলা থেকে মিঠে রসালো শিকড়বাকড় নিয়ে আসছি।” 

তারপর? 
তারপর আর কী! শামুকমশাই, মোটু ছোটু কেঁচোভাইয়েরা আর সাতরঙা শুঁয়োবতী চারজনায় মিলে লাল আপেল সবুজ পাতা আর মিঠে শেকড়বাকড় দিয়ে জমিয়ে নিকপিক করল। 

তুমিও চাইলে দূর দেশের সেই আপেলগাছের তলায় যেতে পারো ওদের সাথে নিকপিক করতে। যেদিনই ঝলমলে রোদ ওঠে সেদিনই ওরা নিকপিক করে কিনা। তবে নিজের খুশিমত খাবার নিতে ভুলো না যেন, নইলে আপেল বটপাতা আর শেকড়বাকড়ই চিবোতে হবে যে! 

(ছবি: আমি)